ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস এর জন্ম দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি

আগামী ২৮ নভেম্বর ২০২৪ আন্তর্জাতিক শ্রমিকশ্রেণীর মহান শিক্ষাগুরু,সাম্যবাদী রাজনৈতিক তত্ত্বকার এবং কাল্ হাইনরিশ মাক্সের প্রিয়বন্ধু ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস-এর ২০৪ তম জন্মবার্ষিকীতে রইল সংগ্রামী লাল সালাম—————
তিনি ১৮২০ সালের ২৮ নভেম্বর জার্মানীর বারামানে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন জার্মানের একজন বড় শিল্পপতি। অত্যন্ত রক্ষণশীল এবং গোঁড়া ধর্মীয় পরিবেশে তিনি ছোটবেলায় লালিত পালিত হয়েছিলেন। কিন্তু অতিমাত্রায় ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ তার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। অচিরেই তিনি ধর্মের ব্যাপারে সংশয়ী হয়ে উঠলেন। ব্যবসা ও রাজনীতির প্রতি তার ছিল বিশেষ ঝোঁক। এ কারণে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়াও ছেড়ে দিয়েছিলেন। ছোটবেলায় তিনি কবিতা লিখতেন, তাও তিনি বাদ দিয়েছিলেন। তিনি পিতার ব্যবসায় হাত লাগাতে লাগলেন এবং তৎকালীন রাজনৈতিক বিষয়ে এবং হেগেলীয় দর্শনের পঠন-পাঠন শুরু করলেন। হেগেলীয় দর্শন অধ্যয়নে তিনি এর বিশেষ ত্রুটিসমূহ লক্ষ্য করতে লাগলেন এবং তার মনে এর বিপুল সমালোচনা জমা হতে লাগলো। তিনি বিভিন্ন বস্তুবাদী দর্শন দ্বারা আকৃষ্ট হতে লাগলেন এবং তৎকালীন কিছু কিছু প্রচলিত সাম্যবাদী চিন্তার সাথে পরিচিত হতে থাকেন, তবে এ সম্পর্কে তার মনে সংশয় দেখা দেয়।
১৮৪২ সালে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং এক বছর সেখানে চাকরি করেন। সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন অবস্থায় তিনি সমকালীন বিশ্বের রাজনৈতিক ও সামরিক নীতি সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেন।সেনাবাহিনী থেকে ফেরার পরে ১৮৪২ সালের নভেম্বর মাসের এক কুয়াশাচ্ছন্ন দিনে তিনি তার পিতার নির্দেশে ইংল্যান্ড গমন করেন।তবে এটা ছিল তার পিতার অধীনে স্রেফ কেরানীর চাকরিমাত্র। তিনি প্রায় দুই বছর ইংল্যান্ডে অতিবাহিত করেন।
পবিত্র পরিবার হচ্ছে একটি বই যা নভেম্বর, ১৮৪৪ সালে কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস রচিত। বইটি ইয়াং হেগেলিয়ানদের এবং তাদের চিন্তার প্রবণতা সম্পর্কে একটি সমালোচনামূলক গ্রন্থ এবং যা ঐ সময়ে একাডেমিকভাবে খুব জনপ্রিয় ছিল। বইটির শিরোনাম প্রকাশকের দ্বারা প্রস্তাবিত এবং বাউয়ের ভাইদ্বয়ের ও তাদের সমর্থকদের একটি ব্যঙ্গাত্মক রেফারেন্স হিসেবে বোঝানো হয়। ১৮৪৫ সালে তিনি নিজের প্রত্যক্ষন এবং গবেষণার ভিত্তিতে ইংল্যান্ডে শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা প্রকাশ করেন।
গ্রন্থটি ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডের শিল্প শ্রমিকশ্রেণীর একটি সমীক্ষা। তিনি সেখানে থাকাকালীন কারখানা শ্রমিকদের দুর্দশা সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত হন এবং রীতিমত গবেষণা করে গ্রন্থটি রচনা করেন।এই গ্রন্থে তিনি শ্রমিকদেরকে তাদের ন্যায্য অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করেন। তিনি আরো দেখান যে, পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় পুঁজিপতি কারখানা মালিকদের দ্বারা শ্রমিকগণ আবশ্যিকভাবেই শোষিত হন। তবে এই ব্যবস্থা বেশিদিন চলতে পারে না, চলা সংগতও নয়। এই ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত মালিক-শ্রমিক দ্বন্দ্বের কারণে তা ভেঙে পড়তে বাধ্য।
বই সংবাদপত্রের অনেক সঙ্গে একটি বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল এবং ব্রুনো বাউয়ের ১৮৪৫ সালে Wigand-এর Vierteljahrsschrift প্রকাশিত বাউইর একটি প্রবন্ধে বইটি খণ্ডন করার চেষ্টা করেন। বাউয়ের দাবি করে মার্কস ও এঙ্গেলস তাকে ভুল বুঝেছেন এবং যা তিনি বোঝাতে চেয়েছেন তা তারা বোঝেননি। পরে মার্কস তার প্রতিক্রিয়ায় নিজের প্রবন্ধ প্রকাশ করেন যা জার্নালে Gesellschaftsspiegel-এ জানুয়ারি ১৮৪৬ সালে প্রকাশিত হয়। মার্কস জার্মান ভাবাদর্শের দ্বিতীয় অধ্যায়ে যুক্তিসমূহ আলোচনা করেন।
১৮৪৫ থেকে ১৮৪৭ সাল পর্যন্ত সময়টা এঙ্গেলস ব্রাসেলস ও প্যারিসে কাটান, এবং তার বৈজ্ঞানিক চর্চার সঙ্গে সঙ্গে ব্রাসেলস ও প্যারিসের জার্মান শ্রমিকদের মধ্যে ব্যবহারিক কাজ মিলিয়ে নেন। এইখানে গুপ্ত জার্মান সমিতি কমিউনিস্ট লিগের সঙ্গে মার্কস ও এঙ্গেলসের যোগাযোগ হয়, এ সংঘ তাদের ওপর ভার দেয় তাদের রচিত সমাজতন্ত্রের মূলনীতি উপস্থিত করার জন্য। ১৮৪৮ সালের যে বিপ্লব প্রথমে ফ্রান্সে শুরু হয়ে পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশেও বিস্তৃত হয় সেই সময় মার্কস এঙ্গেলস দেশে ফেরেন। সেখানে, প্রুশিয়ার রাইন অঞ্চলে তারা কলোন থেকে প্রকাশিত গণতান্ত্রিক ‘নতুন রাইনিশ গেজেটের’ প্রধান হয়ে ওঠেন। রাইনিশ প্রুশিয়ার সমস্ত বিপ্লবী গণতান্ত্রিক প্রচেষ্টার প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠেন দুই বন্ধু।এভাবেই জন্ম নেয় ১৮৪৮ সালে ছাপা মার্কস এঙ্গেলসের সুবিখ্যাত ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’। ছোট্ট এই পুস্তিকাখানি বহু বৃহৎ গ্রন্থের মূল্য ধরে সভ্য জগতের সমস্ত সংগঠিত ও সংগ্রামী প্রলেতারিয়েত আজও তার প্রেরণায় সজীব ও সচল। ১৮৪৮ সালে কার্ল মার্কসের সাথে যৌথভাবে কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার রচনা করেন, পরে কার্ল মার্কসকে পুঁজি গ্রন্থটি গবেষণা ও রচনার জন্য অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করেন। মার্কসের মৃত্যুর পরে তিনি সেই বইয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড-দুটি সম্পাদনা করেন। আরো তিনি মার্কসের “উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্ব” বিষয়ের নোটগুলো একত্রিত করেন এবং এগুলো পরে “পুঁজি”র চতুর্থ খণ্ড হিসেবে প্রকাশিত হয়। তিনি পরিবার অর্থনীতি বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
এ্যান্টি-ডুরিং বইটি ১৮৭৮ সালে জার্মানিতে প্রথম প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থের তিনটি পরিচ্ছেদ_ দর্শন, অর্থনীতি, ও সমাজতন্ত্র-তে পুর্ণাকারে প্রকাশ পায় মার্কসবাদের মতাদর্শগত ঐশ্বর্য। এই বইয়ে এঙ্গেলস কেবল মার্কসবাদের পক্ষই সমর্থন করেননি, প্রলেতারিয়েতের বৈপ্লবিক তত্ত্বের অনেকগুলো নতুন নীতিগত প্রশ্নও বিকশিত করে তোলেন এবং তা করতে গিয়ে তিনি সাধারণীকৃত করেন প্রলেতারিয়েতের সংগ্রামের নতুন অভিজ্ঞতা, বিশ্ববিজ্ঞানের বিশেষত প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সর্বসাম্প্রতিক সাফল্যাদি।
কল্পলৌকিক ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ১৮৮০ সালে লিখিত ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস রচিত একটি গ্রন্থ। এটা প্রথম ১৮৮০ সালে ফ্রান্সে প্রকাশিত হয়।
১৮৭০ সালে এঙ্গেলস লন্ডনে ফেরেন এবং ১৮৮৩ সালে মার্কসের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের কর্মভারাক্রান্ত মিলিত মানসিক জীবন চালিয়ে যান। এর ফল হল মার্কসের দিক থেকে পুঁজি আর এঙ্গেলসের দিক থেকে ছোট বড় একসারি বই। পুঁজিবাদী অর্থনীতির জটিল ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ নিয়ে কাজ করেন মার্কস। আর অতি সহজ ভাষায় প্রায়ই বিতর্কমূলক রচনার সাধারণ বৈজ্ঞানিক সমস্যা এবং অতীত ও বর্তমানের বিভিন্ন ব্যাপার নিয়ে ইতিহাসের বস্তুবাদি বোধ ও মার্কসের অর্থনৈতিক তত্ত্বের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখেন এঙ্গেলস।১৮৯২ সালে ইংরেজি প্রকাশনার জন্য কল্পলৌকিক ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র শিরোনামটি গৃহীত হয়। প্রাথমিকভাবে এই বইটি তার পূর্বের বই এ্যান্টি-ডুরিং গ্রন্থের ভূমিকা, তৃতীয় খণ্ড ও দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের ভিত্তিতে লেখেন। বইটি কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য ব্যাখ্যা করে। এই পুস্তকটি হচ্ছে বৈজ্ঞানিক স্মাজত্নত্রের তত্ত্বের ক্ষেত্রে এক বোধগম্য ভূমিকাস্বরূপ যাতে বর্ণিত হয়েছে মার্কসবাদের তিনটি উৎস এবং তিনটি উপাদানের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ। এঙ্গেলসের এইসব রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দ্যুরিঙের বিরুদ্ধে বিতর্কমূলক রচনা, পরিবার ব্যক্তি মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি (১৮৯৫), ল্যুদভিগ ফয়েরবাখ (১৮৯২), রাশিয়ার প্রসঙ্গে এঙ্গেলস (১৮৯৪)। মার্কস মারা যান, পুঁজি বিষয়ে তার বৃহৎ রচনা সম্পূর্ণরূপে গুছিয়ে যেতে পারেননি। খসড়া হিসেবে অবশ্যই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বন্ধুর মৃত্যুর পর পুঁজির ২য় ও ৩য় খন্ড গুছিয়ে তোলা ও প্রকাশনের গুরুভার শ্রমে আত্মনিয়োগ করলেন তারই অকৃত্রিম বন্ধু শ্রমিক শ্রেণির মহান শিক্ষাগুরু কমরেড ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস।বিশেষ রাজনৈতিক কারণে মার্কস যখন ইংল্যান্ডে স্থায়ী বসবাসের জন্য নির্বাসন নেন, তখন এঙ্গেলসও ইংল্যান্ড চলে আসেন। ব্যক্তিগত জীবনে এঙ্গেলস ছিলেন অত্যন্ত উদার এবং হাসিখুশি ধরনের মানুষ। জীবনে বড় হবার লোভ তার ছিল না। তিনি যা কিছুই করতেন তা কর্তব্য মনে করে বা ভালো লাগার তাগিদে করতেন। মার্কস-এর সহযোগিতা করার মানসিকতা থেকে তিনি দর্শন চর্চা করেছেন বলে স্বীকার করেছেন। মার্কস-এর মৃত্যুর পরেও ইংল্যান্ডে ছিলেন। তবে ১৮৯১ সালে তিনি ম্যানচেস্টার ছেড়ে লন্ডনে চলে আসেন এবং সেখানেই ১৮৯৫ সালের ৫ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।

